সতীন কাঁটা
-প্রলয় কুমার নাথ
মনতোষের ডাক শুনে দরজা খুলে সেদিন হকচকিয়ে উঠেছিল যমুনা।
— “কে এটা? কার মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছো তুমি?”,
মনতোষের কোলে পাঁচ বছরের শিশুকন্যটির দিকে ইঙ্গিত করে চিৎকার করে উঠেছিল যমুনা। মায়ের চিৎকার শুনে খেলা ফেলে সেখানে হাজির হয়েছিল মনোতোষ আর যমুনার আট বছরের ছেলে প্রতুলও। মনোতোষ কোন উত্তর দেয়নি স্ত্রীর প্রশ্নে, হয়তো যমুনার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সেদিন ভয় পেয়েছিল সে। শুধু বাচ্ছা মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে প্রতুলের পাশে রেখে সে ছেলেকে বলেছিল,
— “এটা তোর একটা বোন রে খোকা…ওর নাম আভা…আজ থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে!”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল যমুনা। এমনিতেই টানাটানির সংসার তাদের, তার ওপর আবার কোথা থেকে এই মেয়েকে জোগাড় করে এনে বলছে সে নাকি এখন থেকে এখানেই থাকবে! স্বামীর প্রতি আবার চিৎকার করে উঠেছিল যমুনা,
— “কি গো, কে এই মেয়েটা? আর ও এখানে থাকবে কেন? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে বড়…”
— “আভা আমারই সন্তান যমুনা…আর তাই সে আজ থেকে এখানে থাকবে!”
রাগে বিতৃষ্ণার যমুনার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল সেই দিন। তার মানে পাড়ার এর ওর মুখে এতদিন মনতোষের সম্বন্ধে সে যা শুনেছে তা ঠিক! সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
— “তোমার কি কোন লাজ লজ্জা নেই গো? ওই মেয়ে এই বাড়িতে কিছুতেই থাকতে পারবে না এই আমি বলে দিলুম…”
— “আভা আমার আর মালতীর একমাত্র সন্তান যমুনা…আর আজ মালতীর অবর্তমানে ওকে প্রতিপালন করা আমার দায়িত্ব। তাই ও এখানেই থাকবে। তোমার কোন অসুবিধা হলে এই বাড়ির দরজা খোলা আছে…”
যমুনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ছোট্ট মুদিখানার দোকানের মালিক মনোতোষ স্ত্রী যমুনা আর ছেলে প্রতুলকে নিয়ে এই গ্রামের অনেক বছরের বাসিন্দা। কোন মতে এক প্রকার চলে যাচ্ছিল যমুনায় সংসার, যতক্ষন না ওই ঢলানী সর্বনাশী মাগী মালতীর নজর পড়েছিল তার স্বামীর ওপর। পাশের গাঁয়ের হারান পোস্ট মাস্টারের স্ত্রী হয়ে এসেছিল গরীব ঘরের সুন্দরী বাপ মা মারা মালতী। কিন্তু বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনাটা। একদিন দুপুরে হারানের বালিশের নীচে গোল্লা পাকিয়ে ছিল ছোট আকৃতির একটি কেউটে, আগে থেকে বুঝতেই পারেনি হারান। দুপুরের খাওয়ার খেয়ে শুতে গিয়েই…কামড়ের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা গিয়েছিল হারান। তারপর থেকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকত মালতী। বাচ্ছা কাচ্চা কিছু হয়নি তার, পরিবারে শয্যাশায়ী অসুস্থ শ্বাশুড়ি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর থেকেই মনতোষের সঙ্গে আস্তে আস্তে পিরিত হয় মালতীর, যার সূত্রপাত প্রথম প্রথম মাস কাবাড়ি বাজার করতে মনতোষের দোকানে আসার অছিলা। সেই টানেই মাঝে মাঝে মনোতোষও ছুটে যেত মালতীর বাড়িতে, এমনকি তার বিছানাতেও। মালতীর শয্যাশায়ী শ্বাশুড়ির কিছুই বলার ক্ষমতা ছিল না। মনোতোষ নাকি গোপনে বিয়েও করেছিল মালতীকে! সেই নষ্টামীর ফসলই কী এই বাচ্চা মেয়েটা? রাগে বিদ্বেষে ফুঁসতে থাকে যমুনা। এই সব কথা তার লোক মুখে শোনা, বহুবার মনোতোষকে জিজ্ঞাসা করলেও সে নিজমুখে কোন সন্তোষ জনক উত্তর দেয়নি যমুনাকে। তবে আজ সে বলে ওঠে,
— “গত পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল মালতী…গতকাল সে মারা গিয়েছে, যমুনা! ওদের বাড়িতে আভার দেখাশোনা করার কেউ নেই, তাই আমি ঠিক করেছি আজ থেকে তুমিই হবে ওর নতুন মা!”
মালতীর মৃত্যু সংবাদ শুনে কিঞ্চিৎ খুশি হলেও আজ থেকে এই সতীন কাঁটা নিয়ে সংসার করতে হবে এটা ভেবেই বিষিয়ে ওঠে যমুনার মন।
*
এরপর কাটতে থাকে দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর। একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে আভা এবং প্রতুল। তবে নিজের পেটের ছেলের প্রতি যে স্নেহ এবং ভালবাসা যমুনার মনে ছিল তার শিকি ভাগও ছিল না আভার জন্য। সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যেই বড় হয়েছে আভা, দেখেছে যে তার সৎ মা প্রতুল এবং তার প্রতি কতটা ভিন্ন মনোভাবগ্রস্থ। ভালো মন্দ খাবার, পোশাক আশাক এমনকি শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে যমুনা পক্ষপাতিত্ব করে গিয়েছে নিজের পেটের ছেলেকে। প্রথম প্রথম এই ব্যাপারে কিছুটা বাধা দিত মনোতোষ, কিন্তু পরে যমুনার সাথে ঝগড়া আর অশান্তির ভয়ে সেও মেনে নিত আভার প্রতি এই অনাচার। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সবার আগে যমুনা পাত পেরে খাওয়াত প্রতুল ও তার স্বামীকে। তারপর তার নিজের খাওয়া হলে, অবশিষ্টাংশ যেন বাড়ির কুকুরের মত রেখে দিত আভার সামনে। এই অভাবের সংসারেও প্রতুলের জন্য পুজোয় একাধিক দামী পোশাক কেনা হত, কিন্তু আভার জন্য হয়তো কোন বার কিছু কেনা হতই না, বা হলেও সেই সস্তা সিটের ফ্রক। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো আভা, প্রতুলের মত নয় যে প্রতিটা ক্লাসেই একাধিক প্রয়াসে পাশ করতে হবে। তবুও প্রতুলের জন্য প্রতি বছর আসত নতুন বই, খাতা, ইউনিফর্ম, ব্যাগ, আর আভাকে এত ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও উঁচু ক্লাসের দাদা দিদিদের পা ধরে নিজের জন্য খুঁজে নিতে হত তাদের পুরোনো বইগুলো। প্রতুলের জন্য স্কুলের টিফিনে থাকতো লুচি, আলুর দম, মিষ্টির মত কত কি সুখাদ্য, আর আভার জন্য রোজ বরাদ্দ থাকতো শুধুমাত্র শুকনো মুড়ি। আভাকে দেখলেই যেন মালতী আর মনোতোষকে এক বিছানায় থাকার দৃশ্য ভেসে উঠত যমুনার চোখের সামনে। তাই মেয়েটাকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না যমুনা, ওর গলার মা ডাকটা শুনলেই যেন সর্বাঙ্গে জ্বালা করে উঠত যমুনার।
শুধু তাই নয়, নিজের পেটের ছেলের থেকে ওই দুশ্চরিত্রা মালতীর গর্ভজাত সন্তান এত বেশি মেধাবী, এটাও সহ্য হত না যমুনার। তাই সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে সে ক্লাস নাইনের পরই আভার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। আভার খুব ইচ্ছা ছিল আরো পড়াশোনা করার, কিন্তু যমুনার রক্তচক্ষুর সামনে তার কিছুই মুখ ফুটে বলার উপায় রইল না। কিন্তু এত পড়াশোনার চেষ্টা সত্ত্বেও মাধ্যমিকটা কোন ভাবে পাশ করে, উচ্যমাধমিকে একাধিক বিষয়ে ব্যাক পেয়ে নিজে থেকেই পড়া ছেরে দিল প্রতুল। মনোতোষ একবার যমুনাকে বলেছিল,
— “নিজের পেটের ছেলের বিদ্যের দৌড় তো দেখলে…আমি বলি আভাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই! ঘরে একজন তো লেখাপড়া শিখুক!”
— “মেয়ে মানুষের অত পড়ার কোন দরকার নেই! কি হবে অত লেখাপড়া করে! দুদিন পরে সেই তো আবার অত খরচ করে বিয়ে দিতে হবে ওকে, গিয়ে তো সেই হাতা খুন্তি ঠেলবে!”
— “না তবুও…মেয়েটা যখন পড়তে চায়…”
— “না কোনদিন নয়। কি প্রমান করতে চাও তুমি, যে তোমার নিজের ছেলে পড়া লেখা শিখল না, আর ওই বেশ্যা মাগীর মেয়ে বিদ্যেধরী! খবরদার, ওকে পড়ানোর কথা বললে আমি অনর্থ বাধাবো বলে দিলাম!”
প্রথমে আভাকে এই বাড়িতে রাখা নিয়ে যতটা স্পষ্ট ভাবে যমুনার সামনে নিজের বক্তব্য রাখার ক্ষমতা ছিল মনতোষের, এখন যেন তার অনেকটাই হারিয়েছে সে। তার কারণ এই বয়সে এসে আর পারিবারিক কলহ বাড়াতে চায় না সে। তাই চুপ করে মেনে নিয়েছিল যমুনার কথা।
আভা সমস্তই শুনতো তার সম্বন্ধে তার সৎ মা কি বলছে। সেই অল্প বয়স থেকে যমুনাকেই নিজের মা হিসাবে দেখত সে, আপ্রাণ চেষ্টা করত তার মন জুগিয়ে চলার। কিন্তু একটা প্রবাদ আছে না ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’, ঠিক সেভাবেই প্রতুলের জন্য যে স্নেহ ভালোবাসা যমুনার মনে ছিল তা কোন দিন গড়ে ওঠেনি আভার জন্য। মাঝে মাঝে মালতীর কথা বড্ড মনে পড়ত আভার, চোখের জলে ভিজে যেত মাথার বালিশ।
— “তোমার সাথে আমাকেও কেন নিয়ে গেলে না মা, এখানে যে অন্যের চক্ষুশূল হয়ে বেঁচে থাকতে পারছি না আমি!”
কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় নিরুত্তর হয়ে রইতেন এই অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ শুনে। এমনই সময়ে হঠাৎ করে এক রাত্রে স্ট্রোক হয়ে ইহলোকের মায়া ছেড়ে চলে গেল মনোতোষ। যে মানুষটা একটু হলেও সহানুভূতিশীল ছিল আভার প্রতি সেও আর রইল না। প্রতুল গিয়ে বসল বাবার দোকানে। এবার তো যমুনার দৌরাত্ব আরো বেড়ে গেল। সে উঠে পড়ে লাগল আভাকে পাকাপাকি ভাবে এই বাড়ি থেকে বার করতে। এমনই সময় পাশের গাঁয়ের মণিময় চক্রবর্তীর সাথে আভার বিয়ের সম্বন্ধটা যেন লুফে নিল যমুনা। মণিময় হলেন বেশ বড় বস্ত্র ব্যবসায়ী, কলকাতায় একটি বেশ বড় কাপড়ের দোকান আছে তার। তাই তার বাড়িতে গিয়ে খাওয়া পরার অভাব হবে না আভা জানত। তবে দোষের মধ্যে মণিমায়ের বয়সটা একটু বেশি, প্রায় পঞ্চাশের কাছে। তার প্রথম স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়, বাচ্ছাটিকেও বাঁচানো যায়নি। তার পর থেকে আর বিয়ে করার ইচ্ছাই ছিল না মণিময়ের। পরে আত্মীয় স্বজনের অনেক বলাবলিতে দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিয়েছেন মণিময়। কোন দাবি দাওয়া নেই, এক বস্ত্রেই আভাকে ঘরে তুলতে চান তিনি। এই পরিস্থিতিতে নিজের স্বপ্নগুলোকে অনেক আগেই গলা টিপে মেরে ফেলেছিল আভা। তাই এমন বেশি বয়সের দোজবর পাত্রকেই বিয়ে করতে রাজি হল সে। শুধু একবার যমুনাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে সে বলে উঠেছিল,
—- “তাও তো ভালো যে জামাইএর আগের বউয়ের বাচ্চাটা জন্মাবার আগেই মারা গিয়েছে, তাই তোকে আর আমার মত সতীন কাঁটা নিয়ে ঘর করতে হবে না!”
সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি আভা। সে বুঝতে পেরেছিল যমুনার মনে সৎ মেয়ের জায়গা থেকে কখনো নিজের মেয়ের জায়গায় সে পৌঁছতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই মণিময়ের সাথে বিয়ে করে সেই বাড়ি ত্যাগ করেছিল আভা।
*
বেশ কয়েকটি বছর কেটে গিয়েছে। মণিময়ের পরিবারে খারাপ নেই আভা। বেশি বয়সে হলেও আভাকে সন্তান সুখ দিতে সমর্থ হয়েছে মণিময়। আর কয়েক দিন পরে নিজের একমাত্র ছেলে টুবলুর মুখে ভাতের অনুষ্ঠানটা খুব ভালো করেই আয়োজিত করতে চান ধনী ব্যবসায়ী মণিময়। সেই সূত্রেই তাদের এতবড় বাড়িটা এখন থেকেই গমগম করতে শুরু করেছে আত্মীয় স্বজনের ভিড়ে। কলকাতা থেকে এসেছে মণিময়ের এক দূরসম্পর্কের বোন, নাম শোভনা। বয়সে অনেকটা আভার মতই সে। কিন্তু আভার থেকে বিস্তর বেশি পড়াশোনা করা শিক্ষিত মেয়ে সে, এখনো বিয়ে করেনি। চাকরি করে কলকাতার একটি নামী বহু-জাতিক প্রতিষ্ঠানে। তবুও আভার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে শোভনার। শোভনার সখ্যতা পেয়ে এবং বিশেষ করে তার শহুরে চালচলন যেন মুগ্ধ আভা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যদি নিজে পড়াশোনাটা কোনভাবে শেষ করতে পারত সে, তাহলে হয়তো সেও কলকাতায় গিয়ে চাকরি করতে পারত, এমন সুন্দর শহুরে আদব কায়দা শিখতে পারত। শোভনার সাথে এতটাই অন্তরিক হয়ে উঠেছিল আভা, যে তার সাজের জিনিসগুলো মাঝে মাঝে নিজেও ব্যবহার করত আভা। একদিন শোভনার কাছ থেকে একটি পারফিউমের বোতল নিয়ে নিজের গায়ে স্প্রে করতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় সেটা দেখে হাহা করে ছুটে এল শোভনা।
— “আরে করছ কি বৌদি! ওটা কোন যে সে সেন্ট নয় গো! ওটা খবরদার নিজের গায়ে স্প্রে করো না…কারণ ওটার কাজ হল যার মুখে স্প্রে করা হয়েছে তাকে নিমেষের মধ্যে অজ্ঞান করে দেওয়া!”
— “সে কি গো! তা এমন জিনিস তোমার কাছে…”
— “কি বলি বলো বৌদি! কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে একা থাকি। প্রায়দিনই অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়! জানই তো কলকাতার রাস্তাঘাট কেমন, বদমাশ ছেলে ছোকরার অভাব নেই…তাই ওটা নিজের কাছে রাখি!”
— “ও আচ্ছা…বাহ বেশ ভালো করেছ ভাই!”
— “শোন না, তুমিও ওটা নিজের কাছে রাখো…যদি কখনো কাজে লাগে।”
— “না না, আমার ওটা আবার কি কাজে লাগবে ভাই…”
— “আরে রাখই না…আমার কাছে ওরকম আরো কয়েকটা আছে…এটা না হয় তোমাকে দিলাম!”
শোভনার পীড়াপীড়িতে ওই সেন্টের বোতলটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল আভা।
আর একদিন পরেই টুবলুর অন্নপ্রাসন। কেমন যেন একটা দোটানায় পড়েছিল আভা। এই বাড়িতে তার স্বামীর পক্ষের এত অতিথিরা আছে, কিন্তু বাপের বাড়ির পক্ষের কেউ নেই। তার বারবার মনে হচ্ছিল একবার যমুনা আর প্রতুলকেও এই অনুষ্ঠানে ডাকলে কেমন হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ওরা আর তেমন যোগাযোগ করেনি আভার সাথে, যেন ঘাড় থেকে আভাকে নামাতে পেরে নিষ্কৃতি পেয়েছে যমুনা। তবুও আজ তাদের কথাই কেন বারবার মনে পড়ছে আভার! হোক না সৎ মায়ের পরিবার, তবুও তো জীবনের এতগুলো বছর তাদের কাছেই কাটিয়েছে সে, তাদের গলগ্রহ হয়ে জীবন কাটালেও অন্তত তাকে বিয়ের আগে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তো দেয়নি তার সৎ মা! তারা ছাড়া আর আভার নিজের বলতে আছেই বা কে? সাত পাঁচ ভেবে টুবলুকে শোভনার কাছে রেখে একটা নেমন্তন্নের কার্ড নিয়ে পরদিন দুপুরেই যমুনার বাড়ির দিকে রওনা হয় আভা। বুকের ভেতর কেমন একটা শিরশিরানি জেগে ওঠে আভার, এত দিন পর কি জানি কেমন আছে ওরা! তাকে দেখেই বা কি বলবে যমুনা! রিকশা থেকে নেমে সেই পরিচিত এক তলা বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসে আভা, যেখানে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে কেটেছে তার জীবনের এতগুলো বছর।
ওদের বাড়িটা লোকালয় থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা মাঠের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে গিয়েও যেন থেমে যায় আভা। দেখে যে বাড়ির সদর দরজাটা ভেজানো! ভেতরে বেশ কয়েকটি মানুষের হুটপাটি এবং ছুটোছুটি করার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই সময় তো প্রতুল দোকানে থাকে, বাড়িতে যমুনায় একার থাকার কথা! তাহলে কারা ঢুকেছে ঘরের ভেতর! আভা আলতো করে দরজাটা খুলে ভেতরের দৃশ্য দেখে আৎকে ওঠে। দেখে যে ঘরের দেওয়ালের এক পাশে যমুনা পড়ে রয়েছে। তার কপালটা অনেকটা কেটে গিয়েছে, বেশ রক্ত বেরিয়েছে সেখান থেকে! বোঝাই যাচ্ছে কেউ খুব বলপূর্বক তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে দেওয়ালের গায়ে!
— “মা…মা কী হয়েছে তোমার?”, চিৎকার করে ওঠে আভা।
আহত যমুনা মেয়ের মুখটা চেপে ধরতে চায় তারপর বিপরীত দিকের একটি ঘরের দিকে কি যেন ইশারা করে দেখাল। কিন্তু তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে আভার কোলে। মুহূর্তের মধ্যে যমুনাকে কোন রকমে টেনে তুলে সদর দরজার বাইরে এনে রাখে আভা। তখনই সে দেখতে পায় ঘরের ভেতর থেকে তিনটে ষন্ডা গোছের ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। এদের একজনের হাতে যমুনার বিয়ের গহনার বাক্স এবং কিছু পয়সা কড়ি। আভা বুঝতে পারে যে তার মানে এরা লুঠপাট করতে এসেছে এই বাড়িতে। ছেলেগুলো তেড়ে আসতে লাগল আভার দিকে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আভার, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার মনে পড়ে যে তার হ্যান্ড-ব্যাগের মধ্যেই রাখা আছে শোভনার কাছ থেকে পাওয়া অজ্ঞান করার স্প্রে বোতলটা! চোখের নিমেষে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে ধরে সে বোতলটি খালি করে দেয় ওই তিনটি ছেলের মুখের কাছে। কি হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওই তিনজন। আর একটুও দেরি না করে বাড়ির সদর দরজাটা বাইরে থেকে ভালো করে বন্ধ করে দেয় আভা। তারপর যমুনাকে কোন রকমে কোলে নিয়ে ছুটে চলে স্থানীয় রিকশা স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
যমুনার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। মাথায় বড় একটা ব্যান্ডেজ বাধা। তার বিছানার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আভা, শোভনা, মণিময় সহ সেই বাড়ির বেশ কিছু লোক। অপর দিকে দাঁড়িয়ে আছেন এক দল কনস্টেবল সহ স্থানীয় থানার ওসি। তাদের কাছেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরে দাঁড়িয়ে আছে ওই তিন বদমায়েশ…কিন্তু একী! তাদের পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতুল! তার হাতেও যে হাতকড়া!
— “বাহ, তাহলে আপনার জ্ঞান ফিরেছে দেখছি। আপনার ভাগ্য ভালো যে সঠিক সময়ে আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছেন আপনার সৎ মেয়ে, আভা…নাহলে হয়তো আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না ডাক্তার বাবুদের!”, বলে উঠলেন ওসি সাহেব।
— “ওরা কারা? আর ওদের সাথে আমার প্রতুলকেও কেন এরেস্ট করেছেন আপনারা?”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল যমুনা।
— “ওরা আর যেই হোক না কেন, এইটুকু জানবেন ওদের আপনার বিবাহের গহনা এবং বাড়িতে রাখা টাকা পয়সা লুট করে আনার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। আর ওরা নিজে মুখে স্বীকার করেছে যে ওদের পয়সার লোভ দেখিয়ে এই কাজ করতে বলেছিল আপনারই ছেলে প্রতুল!”
যমুনার মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার পেটের ছেলে প্রতুল!…সে কিনা নিজের বাড়িতেই ডাকাতি করানোর মত ঘৃণ্য কাজ করেছে! ভাবতেই পারছে না যমুনা…কিন্তু কেন?
— “আপনার এই গুণধর পুত্র যে দোকানে বসার সাথে সাথে জুয়া খেলাও ধরেছে, সেটা নিশ্চয় আপনি জানতেন না যমুনা দেবী। তাই তার বাজারে হয়েছিল বেশ কিছু দেনা। সেটা শোধ করতেই এই অভিসন্ধি!”, বলে উঠলেন অফিসার।
প্রতুল সহ ওই তিনজন শয়তানকে একে একে নিয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। মণিময় এবং তার বাড়ির অন্যান্য লোকেরাও বেরিয়ে গেল হাসপাতালের ঘরটা থেকে। রইল শুধু যমুনা আর আভা। এতদিন ধরে যে পেটের ছেলেকে নিজের সবটুকু দিল যমুনা, তার কাছে তার মায়ের জীবনের কোন দাম নেই। সেখানে তার সতীন কাঁটা, তার সৎ মেয়ে আভা যাকে সারা জীবন সে দুই চোখে দেখতে পারেনি, এত অন্যায় অনাচার করেছে যার সাথে, সেই আভাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আজ তার প্রাণ বাঁচাল। যমুনার চোখের দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করেছিল অনর্গল বয়ে চলা নোনতা অনুশোচনার ধারায়। অস্ফুট কণ্ঠে সে আভাকে বলে উঠল,
— “আয় মা, আয় আমার বুকে আয়!”
আভা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার সৎ মাকে, যার সাথে আজ হয়তো নিজের গর্ভধারিনী মায়ের কোন পার্থক্য নেই।